খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্টে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে ১০ দিনে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা এসব শরণার্থী প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও মানবিক সহায়তার প্রচণ্ড সংকটের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছে।(প্রিয়.কম)
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার সীমান্তে থাকা জাতিসংঘের কর্মীদের হিসাব মতে ২৫ আগস্টের পর থেকে গত ১০ দিনে বাংলাদেশে ৮৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ঢুকেছে। গত বছরের অক্টোবরে একই রকম অভিযানে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে দুর্গম সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। জাতিসংঘ বলছে, অক্টোবরের পর এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করার পর রোহিঙ্গাদের হত্যা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রাণভয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে। তবে মিয়ানমার সরকার বলছে, এই ঘটনার জন্য ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিরা’ দায়ী।
এদিকে, সহিংসতা শুরুর পর থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছেন। প্রতিদিনই নতুন করে আসা শরণার্থীরা সেই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছেন।
রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সেনানির্যাতন শুরু হওয়ার পর জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন।
নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) কর্মকর্তা ভিভিয়েন ট্যান বিবিসি-কে বলেন, যেভাবে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে শিগগিরই আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জরুরি সঙ্কট তৈরি হতে পারে। কেননা পুরানো যে দুটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির (কুতুপালং এবং নয়াপাড়া) আছে, তাতে আর তিল ধারণের জায়গা নেই। স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসা ছাড়াও, বিভিন্ন খোলা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে পালিয়ে আসা মানুষজনকে ঠাঁই দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু একই হারে শরণার্থী আসতে থাকলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি অনানের একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের দিন রাখাইনের বেশ কয়েকটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এর পরপরই ‘সন্ত্রাসীদের’ রুখতে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু করে মিয়ানমার। এ অভিযানে এখন পর্যন্ত ৪০০ জনকে হত্যা এবং ২৬০০ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার কথা শিকার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। যদিও সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, হত্যা ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার এ সংখ্যা আরও বহুগুণ বেশি। তাদের ভাষ্যমতে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শিশুদের জবাই করছে, নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা করছে, পুরুষদেরও বর্বরোচিত নির্যাতনের পর হত্যা করছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা একটি রোহিঙ্গা পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। ছবিটি ০২ সেপ্টেম্বর তোলা। ছবি: এএফপি
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হতে পেরেছে যে রাখাইনে বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ জানায়, রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। গত এক সপ্তাহে ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিপদসংকুল নদী ও সমুদ্রপথে পাড়ি দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে, জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো একই রকম অভিযানে কয়েকশত রোহিঙ্গা নিহত হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় হাজারো ঘরবাড়ি। ওই সময়ে দেশটির সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্য-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের মত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ওই অভিযানের বর্বরতায় বাধ্য হয়ে অন্তত ৮০ হাজার রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে।
রোহিঙ্গা একটি নৃগোষ্ঠীর নাম যাদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ইসলাম ও ১০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। রোহিঙ্গাদের আদি আবাসস্থল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। শত শত বছর ধরে রাজ্যটিতে বাস করা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে মিয়ানমার সরকার এ জাতিগোষ্ঠীকেন নির্মূল করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়ে ইতোমধ্যে কমপক্ষে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
পাঠকের মতামত: